আপনার কী ঘাড়ে ব্যাথা?
ঘাড়ে ব্যাথা একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যে বিষয় নিয়ে তিনজন মানুষের মধ্যে একজন অভিযোগ জানান। ঘাড়ের ব্যাথার কারণ হতে পারে ঘাড়ে খুব সাধারণ মাংশপেশিতে টান অথবা জটিল কোনও পরিস্থিতি, যেমন কশেরুকার স্নায়ু সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া। শিরদাঁড়ার হাড়ের (ভার্টিবা)অসুখ, গেঁটে বাত (আর্থারাইটিস), সারভাইকাল স্পন্ডিলসিস এবং অন্যান্য শারীরিক পরিস্থিতি থেকে ঘাড়ের ব্যাথা হতে পারে, যার অবিলম্বে চিকিৎসা প্রয়োজন। বিশেষত একাধিক সন্তানের মা এবং যাঁদের দুর্বল শরীর বা একটানা ঘাড় ঝুঁকে কাজ করেন তাঁদের ঘাড়ের ব্যাথার ঝুঁকি বেশি থাকে। সাধারণত কোনও দুর্ঘটনার পর ঘাড়ে ব্যাথা হতে পারে, যাকে বলা হয় ‘হুইপল্যাশ’, তার উপসর্গ দীর্ঘবছর ধরে থাকে। ঘাড়ের ব্যাথার চিকিৎসার বিভিন্ন রকমফের আছে এবং তা রোগের মূল কারণের ওপর নির্ভর করে হয়ে থাকে। অধিকাংশ সময়ে ঘাড়ের ব্যাথার নিরাময় এক সপ্তাহের মধ্যে হয়। খুবই কম সময়ে তা বছর বছর থেকে যায়। ঘাড়ের ব্যাথার চিকিৎসার মূল কৌশল ব্যায়াম, এবং সঠিক শারীরিক অঙ্গবিন্যাস(good posture)। সমস্ত বিকল্প ব্যর্থ হলে তখনই একমাত্র অস্ত্রোপচারের কথা ভাবা হয়। দীর্ঘস্থায়ী ঘাড়ের ব্যাথার জন্য, একযোগে একাধিক কৌশল নেওয়া হয় যের মধ্যে থাকে বেশ কিছু মেডিসিন, ব্যায়াম, পেশি শক্ত করার প্রশিক্ষণ, এবং জীবনধারায় পরিবর্তন।
ঘাড়ে ব্যাথার কারণ
একাধিক কারণে ঘাড়ের ব্যাথা হতে পারে, তারই কয়েকটি নিচে বিধৃত হল:
দুর্বল এবং বহুব্যবহার্য পেশি
দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় পেশি টানটান করে বসে থাকলে খিল ধরে এবং কাঁধে এবং ঘাড়ে ব্যাথা হয়। দুর্বল পেশিকে শারীরিক কাজে বেশি ব্যবহার করলে, যেমন সাইকেল করা বা সাঁতার কাটা, তা থেকে ঘাড়ের ব্যাথা হয়।
ঘাড়ের টিস্যুর ক্ষয়
বয়সজনিত কারণে টিস্যুর ক্ষয়ের ফলে সারভাইকাল স্পন্ডিলসিস এবং ঘাড়ে ব্যাথা হতে পারে। যখন হাড়ের মধ্যেকার ফাঁক সঙ্কুচিত হয়ে যায় এবং হাড়ের ধারে ধারে ছোট ছোট অস্থিকণা জন্মায় তখন সেই অবস্থাকে বলা হয়।
কশেরুকার ডিস্ক পরিবর্তিত হওয়া
শিরদাঁড়া বা কশেরুকা ক্ষয় হলে শিরদাঁড়ার ডিসক। বা স্পাইনাল ডিস্ক তার স্থিতিস্থাপকতা হারায়। কোনও কোনও সময়ে স্পাইনাল ডিস্ক টিস্যু ফুলে গেলে স্লিপ ডিস্ক হতে পারে।
কশেরুকের ক্যানাল সঙ্কীর্ণ হওয়া
একটি সঙ্কীর্ণ কশেরুকা ক্যানাল স্নায়ুকে সঙ্কুচিত করে এবং ঘাড়ের ব্যাথার কারণ হতে পারে যা কাঁধ এবং বাহুতে সঞ্চারিত হতে পারে।
শারীরিক আঘাত বা ট্রমা
কোনও দুর্ঘটনায় হঠাৎ ঝাঁকুনি ঘাড় ভাল রকম জখম হতে পারে। এটাকেই বলা হয় হুইপল্যাশ আঘাত।
অঙ্গবিন্যাসে ত্রুটি(Postural dysfunction)
বসার ভঙ্গীতে যদি ত্রুটি থাকে, যেমন দীর্ঘক্ষণ অলস ভঙ্গীতে বসে থাকা, তাহলে ঘাড়ের ওপর খুব চাপ সৃষ্টি করে এবং ঘাড়ে ব্যাথা হয়। আবার, কখনও কখনও ঘুমোবার সময়ে কয়েক ঘণ্টা ঘাড় বেঁকে থাকতে পারে। তা থেকে ঘাড়ে খুব যন্ত্রণা হতে পারে এবং টান ধরতে পারে, যার ফলে মাথা ঘোরাতে অসুবিধা হয়।
ঘাড়ে ব্যথা এর চিকিৎসা
ওষুধ প্রয়োগের সঙ্গে জীবনশৈলীর পরিবর্তন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘাড়ের ব্যাথার চিকিৎসা করা হয়। তার মধ্যে থাকতে পারে ব্যাথা কমানোর ওষুধ, ফোলা বা প্রদাহরোধী ওষুধ, পেশি শিথিল করার ওষুধ, শিরদাঁড়ায় ইনজেকশন, ফিজিক্যাল থেরাপি, চলাফেরায় রাশ টানতে ব্রেস-এর ব্যবহার, সর্বোপরি পশ্চারের পরিবর্তন
ফিজিওথেরাপি
বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, দীর্ঘস্থায়ী ঘাড়ের ব্যাথা অন্যান্য চিকিৎসায় সাড়া দেয় না, এবং পেশি শক্তি বাড়ানোর প্রশিক্ষণ নিলে কাজ দেয়। এই ব্যায়ামগুলি ঘাড়ের অনমনীয় পেশিগুলিকে শিথিল করতে সাহায্য করে। একটি সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে যে, পেশির শক্তি বাড়াতে যে নির্দিষ্ট ব্যায়াম আছে তা নিয়মিত করা হলে ঘাড়ের ব্যাথা থেকে দীর্ঘস্থায়ী স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায়। যদি আপনার ঘাড়ে কয়েক মাস ধরে ঘাড়ে ব্যাথা থাকে তাহলে আপনার ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন এবং পেশির শক্তি বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চান, যা ব্যাথা কমাতে সাহায্য করবে। মনে রাখবেন, কোনও ব্যায়াম শুরু আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, বিশেষ করে ঘাড়ে ব্যাথা থাকাকালীন অবস্থায়। যদি এমন কোনও পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে ব্যায়াম করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে তাহলে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক আপনাকে ব্যায়াম বন্ধ করার পরামর্শ দেবেন। এছাড়াও আমাদের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাতে mobization , electrotherapy ইত্যাদির সাহায্য নেওয়া হয় ।
অস্ত্রোপচার
খুব অল্প সময়েই অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয় না , যখন বিকল্প সমস্ত রকম চিকিৎসা ব্যর্থ হলে তবেই অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জটিল পরিস্থিতিতে, যেমন সারভাইকাল স্পাইন অস্থিতিশীলতা (ইনস্টেবিলিটি) বা নিউরোলজিক্যাল ডিসফাংশনের সময়ে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।
নিজের যত্ন
যদি আপনি আপনার ঘাড় না নাড়াতে পারেন তাহলে আপনি কিছু বিশেষ কাজ কর্ম করবেন না, যেমন গাড়ি চালানো বা ঘোড়ায় চড়া, কারণ তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘাড়ের আন্দোলন বন্ধ করবেন না বা ঘাড়ের কলার পরবেন না।
ব্যাথার উপশমের জন্য ঘাড়ে গরম বা ঠান্ডা সেঁক নিতে পারেন।
ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতে যন্ত্রণা নিরোধক ওষুধ, যেমন প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করতে পারেন। মনে রাখবেন, নিজের ইচ্ছামত ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে এবং পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। যদি আপনার ব্যাথা এক সপ্তাহের মধ্যে না কমে তাহলে কোয়ালিফায়েড ফিজিওথেরাপিস্ট এর সঙ্গে পরামর্শ করুন।.
জীবনশৈলী ব্যবস্থাপনা (লাইফ ম্যানেজমেন্ট)
স্বাস্থ্যসম্মত জীবনশৈলী ঘাড়ের ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধা দেয়। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, কিছু অভ্যাস, যেমন মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ বা এড়ানো, ধূমপান বন্ধ করা, এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যতালিকা অনুসৃত হলে ঘাড়ের ব্যাথা নিয়ন্ত্রণ এবং রোধে তা রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনশৈলী শুধুমাত্র ঘাড়ের ব্যাথা রোধ করে না, ব্যাথা যাতে না হয় সে ব্যাপারেও তার ভূমিকা থাকে। যদি ঘাড়ের ব্যাথায় অক্ষম হয়ে যান এবং কোনও থেরাপিতে উপকার না হয়, জীবনশৈলী ব্যবস্থাপনা ঘাড়ের ব্যাথা কমাতে বড় ভূমিকা পালন করে।
দীর্ঘস্থায়ী ঘাড়ের ব্যাথার সঙ্গে মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, অবসাদ এবং দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে। যদি আপনার চাপ এবং দুশ্চিন্তা বারবার আসে তাহলে সেগুলি কমালে দীর্ঘস্থায়ী ঘাড়ের ব্যাথার উপশম হতে পারে। ঘরের বাইরে বেশিক্ষণ কাটান এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন। মানসিক চাপের মোকাবিলা করার জন্য কোনও একটি হবি সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করুন এবং সে বিষয়ে অভ্যাস করুন।